জাতীয় পরিচয়পত্রে অভিশ্রুতির নাম বৃষ্টি খাতুন, মরদেহ হস্তান্তরে জটিলতা
আপলোড সময় :
০২-০৩-২০২৪ ১১:১০:২৩ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
০২-০৩-২০২৪ ১১:১০:২৩ পূর্বাহ্ন
সংগৃহীত
রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বনগ্রাম গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়।
তার বাবার নাম সবুজ শেখ ওরফে শাবলুল আলম এবং মায়ের নাম বিউটি খাতুন। কলেজের সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর নাম বৃষ্টি খাতুন উল্লেখ রয়েছে বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়ার খোকসার বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠলেও অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো চলাফেরা করতেন, নিজেই নিজের নাম বদলে 'অভিশ্রুতি' রাখেন। সহকর্মীরাও তাকে অভিশ্রুতি হিসেবেই চিনতেন। হিন্দিতে কথা বলায় পটু ছিলেন তিনি।
তার যাতায়াত ছিল রমনা কালী মন্দিরেও। তবে পারিবারিক পরিচয় গোপন করতেন। কর্মক্ষেত্রে জমা দেওয়া বায়োডাটায়ও নিজেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে উল্লেখ করেছেন এই তরুণী। কিন্তু মৃত্যুর পর মরদেহ শনাক্ত ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ার সময় জানা গেছে তার আসল নাম, আর এ নিয়েই তৈরি হয়েছে জটিলতা।
অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টির বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসার বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ জানান, অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। তিনি মুসলিম পরিবারের মেয়ে। বৃষ্টিরা তিন বোন। বৃষ্টি বড়। তার মেজো বোন ঝর্না ও ছোট বোন বর্ষা। তাদের বাবা শাবলুল আলম ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং তার মা বিউটি বেগমও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বৃষ্টি ইডেন কলেজে পড়াশোনা করতেন। তার জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রেও নাম বৃষ্টি খাতুন।
বাবা শাবলুল ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি মেয়ের মরদেহ নিতে মর্গে গেছেন। কিন্তু নামপরিচয় স্পষ্ট না হওয়ায় মরদেহ হস্তান্তরে জটিলতা দেখা দেয়। কোন রীতিতে সৎকার করা হবে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন জাগে। রমনা কালী মন্দিরের পক্ষ থেকেও তার মরদেহ নিতে আসেন সেখানকার পুরোহিত। তবে শেষপর্যন্ত মরদেহটি 'বৃষ্টি খাতুন' হিসেবেই পরিবারের কাছেই হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে ও প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা যায়।
এর আগে অভিশ্রুতির প্রকৃত পারিবারিক পরিচয় নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তার পরিচিত কেউ কেউ দাবি করেছেন, বৃষ্টির বাবা-মা ভারতের বেনারসে পুরোহিত ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর মেয়েটি কোনো এক ঘটনাচক্রে কুষ্টিয়ার শাবলুলের কাছে বড় হয়। এদিকে বৃষ্টি খাতুন যে ফেসবুক এবং চাকরিক্ষেত্রে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন, এটা জানতেন না পরিবারের কেউ।
জানা গেছে, অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে এসএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৮ সালে ঢাকায় এসে ইডেন মহিলা কলেজে দর্শনে অনার্সে ভর্তি হন।
প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হতে আজ নিহত অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টির ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা গেছে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে তার নাম বৃষ্টি খাতুন লেখা আছে। বাবার নাম শাবলুল আলম সবুজ শেখ আর মায়ের নাম বিউটি বেগম লেখা আছে।
শাবলুল আলমের দেওয়া ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্যেরও মিল পাওয়া গেছে। শুক্রবার (১ মার্চ) রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল জব্বার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নিহত সাংবাদিক অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টির বাবা শাবলুল আলম সবুজ শেখ বলেন, সে আমার মেয়ে। সে আমার তিন মেয়ের মধ্যে বড়। আমার আরও দুটি মেয়ে রয়েছে। আমি তাকে নিতে এসেছি।
পরিচয় নিয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে সাংবাদিক আদিত্য আরাফাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, জট খুললেও বিতর্ক থেকে যাবে। সাংবাদিক অভিশ্রুতির ধর্ম পরিচয় নিয়ে এ বিতর্ক। বেইলি রোডের আগুনে নিহত এ সাংবাদিককে হিন্দু ধর্মমতে নাকি মুসলিম ধর্মমতে দাফন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছিল। গণমাধ্যমে তার বাবা মা পরিচয়ে যারা কথা বলেছেন, তারা জানিয়েছেন, অভিশ্রুতির আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। ও মুসলিম। মৃত সন্তানের ধর্ম পরিচয় নিয়ে মিথ্যে বলারও কথা নয়।
আমি মনে করি, মিথ্যে বলে ওদের লাভই বা কি! তাদের যে মেয়ে, এ নিয়ে তারা তথ্য প্রমাণও দিয়েছেন। এখন মা বাবা তাদের সন্তানকে মুসলিম ধর্ম পরিচয়ে দাফন করতে চান। অন্যদিকে অভিশ্রুতি বলে আমরা যাকে জানি তার ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি, মণ্ডপে পূজার কিছু ছবি।
তাতে হিন্দু মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক। অভিশ্রুতির বাবা-মা হিন্দু হলে অথবা অভিশ্রুতি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলে অবশ্যই সনাতন ধর্ম অনুযায়ী সৎকার হওয়া উচিত।
এদিকে অভিশ্রুতির একাধিক বন্ধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন, নাম অভিশ্রুতি দিলেও তার বাবা-মা মুসলিম। সবশেষ পুলিশ তার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিশ্চিত করে জানিয়েছে, তার বাবা-মা দাবিদার যারা তারা সত্য বলেছেন। ওরাই ওর প্রকৃত বাবা মা। তবে এখন মুসলিম পরিচয়ে দাফন হলেও সামাজিক সংকট থেকে যাবে। মেয়েটা সব এত জটিল করে রেখে গেলো কেন জানি না!'
নিজেকে অভিশ্রুতির ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেওয়া মাহফুজুর রহমান নামের তরুণ ফেসবুকে লিখেছেন, ও যাদেরকে বাবা-মা হিসাবে পরিচয় দিত, তারা মুসলিম হলেও ও নিজে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। কারণ, তার মতে কুষ্টিয়ার সবুজ শেখ ও তার স্ত্রী মূলত অভিশ্রুতির পালক পিতা-মাতা, এবং ওকে ভারতের কোনো একটা হিন্দু পরিবার থেকে দত্তক নেয়া হয়েছিল।
যদিও কুষ্টিয়ার বিউটি বেগম দৃঢ়ভাবে দাবী করতেন ও আমাদের পরিবারেই জন্ম নিয়েছে, ও অবশ্যই মুসলিম, ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত নামাজ পড়তো, তারপর ওর বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। এসব বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে জটিলতা চলছিল অভিশ্রুতির।
রমনা কালী মন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বলছেন, নিয়মিত মন্দিরে এসে হিন্দু ধর্ম চর্চা ও পূজা-অর্চনা করতেন ওই সাংবাদিক তরুণী। অনেকে বলছেন, মেয়েটির নাম বা ধর্ম পরিচয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় যেন মূল দুর্ঘটনা আড়ালে না পড়ে। অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি যে মতবাদেরই হন না কেন, তিনি মারা গেছেন দুর্ঘটনায়। এই দুর্ঘটনাটি যেন কোনোভাবেই হালকা করে দেখা না হয়।
এদিকে বৃষ্টি নাম পরিবর্তন বা ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন কি-না, এমন প্রশ্নে বাবা শাবলুল আলম বলেন, এমন কোনোকিছু আমরা জানি না। এক বছর আগে আমি একবার শুনেছি, মন্দিরে গেছে। একজন মন্দিরে যাওয়ার ছবি দেখিয়েছে।
শুনেছি হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের সাথে চলাফেরা করে, একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছে, তাদের সাথে গেছে। তিনি বলেন, মেয়ের সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নাই, হিংসা নাই। মাঝেমধ্যে আমার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে, টাকাপয়সা লাগলে নিয়েছে।
শুক্রবার রাত ১১টা পর্যন্ত অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টির লাশ বুঝে পাননি শাবলুল আলম সবুজ শেখ। শুরুতে তাকে একবার প্রতারক সন্দেহ করে আটকও করা হয়েছিল। তবে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ লাশ হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে লাশ কুষ্টিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডে মারা যান অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের হয়ে নির্বাচন কমিশন বিট কভার করতেন। দুর্ঘটনার আগে এক বন্ধুর সঙ্গে গ্রিন কোজি কটেজের একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন তিনি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Monir Hossain
কমেন্ট বক্স